,

নড়াইলে মধুমতি কেটে চলছে ইটভাটা

নড়াইল প্রতিনিধি: ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠের অবাধ ব্যবহার, বছরের পর বছর ধরে পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সনাতন পদ্ধতির চিমনি। এমনকি লাইসেন্স ছাড়াই ইটভাটা আর সবুজ পরিবেশ ধ্বংস করে ইট পোড়ানো এগুলো সবই চলছে নড়াইলে। সম্প্রতি ধরা পড়েছে মধুমতি নদী কেটে ইটভাটার মাটি ও বালি সংগ্রহ। ৩ বছর ধরে চলা এসব ইটভাটাতে সরকারি বিভিন্ন মহলের দেখভালের পরেও নির্দিধায় চলছে নদী কেটে ইট তৈরীর কাজ।

নড়াইলের মধুমতি নদী। প্রমত্তা এই নদী বর্ষাকালে এলাকার মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে ওঠে। নদীর লোহাগড়া উপজেলার শিয়েরবর,রামকান্তপুর, কালনাসহ নানা এলাকা চরম নদী ভাঙনের মুখে পড়ে। আর বছরের পর বছর ধরে চলা এসব ভাঙন ঠেকাতে হিমশিম খেতে হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। আর এখানেই মধুমতি  নদী তীরে শালনগর ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে অন্ততঃ ৭টি ইটভাটা। যাদের মধ্যে ৩ টি ভাটার মাটি সংগ্রহ করে সরাসরি নদী কেটে। কয়েক বছর ধরে এরসব কাজ চললেও দেখার কেউ নেই।

মধুমতি নদীর পাড়ে রামকান্তপুর গ্রাম এখানে ৮ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে মোল্যা ব্রিকস। নদীপাড়ের আবাদী জমিতে ২০১৬ সালে গড়ে ওঠে এই ভাটা। পরিবেশ আইনের আওতায় ২ একরের বেশি জমি, ফসলী জমিতে ভাটা না করার নিয়ম থাকলেও এবছর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও পেয়েছে এই ইটভাটাটি। শুরুর বছরে কেবলমাত্র শালনগর ইউনিয়ন পরিষদের একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে যাত্রা শুরু করা মোল্যা ব্রিকস শুরু থেকেই মধুমতি নদীর মাটি আর বালি কেটে ইটভাটায় লাগাচ্ছে। গত দুই বছর ধরে নদীর পাড়ের মাটি উপরিভাগের অংশ কেটে ভাটায় লাগালেও এবছর থেকে শুরু হয়েছে তলদেশের মাটি কাটা। প্রায় ৩০ ফুট গভীর করে কয়েকশ মিটার এলাকার মাটি কেটে  ভাটার ইট তৈরি হচ্ছে। এর ফলে নদী পাড়ের অন্ততঃ ৫’শ মিটার এলাকায় মাটি ধ্বসে যেতে শুরু করেছে।

এখানে বসানো হয়েছে মাটি কাটার স্কেবিটর। প্রতিদিস ৭/৮ হাজার ফুট মাটি কাটছে বলে জানায় স্কেবিটর চালক গোপালগঞ্জের ইউনুস। অবৈধভাবে নদীর মাটি কাটছেন কেন এম প্রশ্নের জবাবে ইউনুস বলে,পান্নুভাই আমাকে ডেকে নিয়ে আসছে আমরা মাটি কেটে দিয়ে চলে যাব। এটার ওনার নিজের জমি বলেছে উনি। নীচের মাটি ও বালি কেটে তা ঝুড়িতে করে তুলে আনছে ২০/২২ জন শ্রমিক। তাদের একজন দিনমজুর ওমর আলী বলেন, এটা অন্যায় কিনা জানিনা তবে আমরা সকাল থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত মাটি তুলি আর মজুরি পাই।

এই ইটভাটার প্রতিদিনের মাটিও বালি জোগাড় হচ্ছে নদী কেটে। মাটি কাটার স্কেভিটর  বসিয়ে দিনের পর দিন সকলের সামনেই নদীর পাড় কেটে তা ইট তৈরির কাজে লাগানো হচ্ছে, দিনে কাটা হচ্ছে ৭/৮ হাজার ফুট মাটি,লেবার দিয়ে তলের বালিও তোলা হচ্ছে। ৮ একর জমির প্রায় এককোটি ইটের মাটি ও বালি যোগাড় হচ্ছে  মধুমতি নদী থেকে। বালিমাটি হওয়ায় ইটের মানও বেশ ভালো হচ্ছে।ফলে নদী কেটে রাতারাতি কম পুজিতে ব্যবসা আরো বড় করছেন পান্নু মোল্যা।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু এই ভাটাই নয় পার্শ্ববর্তী হীরা ব্রিকস, চর শামুকখোলার আরো একটি উটভাটায় নদীর মাটি কেটে তা দিয়ে ইট তৈরী করা হচ্ছে। স্থানীয় শিয়েরবর গ্রামের আলাউদ্দিন মোল্যা জানান, এই জমি পান্নু মোল্যার বলেই জানি,তাই উনার জমির মাটি কেটে উনি ভাটায় লাগাচ্ছেন,তবে নদীর তো অবশ্যই ক্ষতি হচ্ছে।কিছু বললে উনি বলেন‘আমার জমির মাটি আমি কাটছি’এই জন্য কেউ কিছু বলে না।

ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স  দিয়ে শুরু করা ইট ভাটাটি ইতিমধ্যে পরিবশে অধিদপ্তরের  ছাড়পত্র ও পেয়েছে ভাটা চালু রাখার। ভাটা মালিক পান্নু মোল্যা জানান, ডিসি অফিসের রেজিস্ট্রেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র সবকিছুই আছে আমার। নদীর মাটি কেটে ভাটা তৈরি এই আদেশ কে দিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমাদের নিজেদের জমি, নদীর মধ্যে ও জমি আছে। এটা করা অপরাধ জেনে তিনি প্রতিবেদককে আপোস করতে নিজের অফিসে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন।

নদী কেটে এসব ইটভাটা তৈরির ঘটনায় ক্ষুব্ধ সচেতন মহল। নড়াইলে নদী বাচাও আন্দোলনের নেতা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার এড. এস এ মতিন বলেন, সরকার দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স এর কথা বললেও পরিবেশ আর প্রশাসনের লোকেরা কোন অজ্ঞাত কারনে এদর ছেড়ে দেয় ঠিক বুঝি না। এগুলো চরম অন্যায়। নদী বাচাতে হলে এখই এই নদী খেকোদের রুখতে হবে।

নদী রক্ষা কমিটির আরেক নেতা শরীফ মুনীর হোসের বলেন, মধুমতি নদীর ভাঙন কবলিত এলাকায় যারা ইটের ভাটা তৈরি করে নদী ধ্বংস করছেন, নদী ভাঙনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন তাদের এখনই আইনের আওতায় আনা দরকার। সবাই যেন টাকার কাছে জিম্মি হয়ে না যায়।

স্থানীয় শালনগর ইউপি চেয়ারম্যান খান তসরুল ইসলাম,যিনি নিজেও একটি ইটভাটা মালিক তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নের অর্ধেকটাই মধুমতির নদীর ভাঙন কবলিত। ওই এলাকায় কয়েকটি ভাটা নদীর মাটি কেটে ইট বানাচ্ছে এটা আমি দেখেছি, কয়েকজনকে নদীর মাটি না কাটার অনরোধ করেছি। আমি আবারও বলবো এবং প্রশাসনকে অবহিত করবো।

নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ড এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো.শাহানেওয়াজ তালুকদার জানান, মোল্যা ব্রিকস নদী কেটে ইটভাটা তৈরি করেছে এটা জেনেছি। এত করে জেলার সবচেয়ে ভাঙন কবলিত এলাকা আরো ঝুকিতে পড়বে। আমি জেলা প্রশাসন কে অবগত করেছি। আশাকরি দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নড়াইলের জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা বলেন, আমি এ জেলায় যোগদান করেই ইট ভাটা মালিকদের ডেকে পরিবেশের ক্ষতি করে ইট ভাটা তৈরি বন্ধ করতে বলেছি। পরিবেশ বান্ধব নয় এমন অনেক ইটভাটা ইতিপূর্বে লাইসেন্স পেয়েছে, আমরা সেগুলোতে অভিযান চালাচ্ছি। আপনাদের মাধ্যমে জানলাম নদীর মাটি কেটে ইটভাট তৈরি হচ্ছে, এটা মেনে নেয়া হবে না।

এই বিভাগের আরও খবর